পপকর্ণ টাইমঃ নিকট ভবিষৎতে আমাদের মুভি দেখার পদ্ধতি হয়তো এমনটাই হবে!
সিনেমা হলে মুভি দেখতে বসলে প্রথমেই কোন জিনিসটার কথা আমাদের সবার আগে মনে পড়ে? হুম ঠিক ধরেছেন, পপকর্ণ! তো সফটওয়্যার ডেভেলপাররা এবার অনলাইন দুনিয়ায় এই নামে নিয়ে এসেছে এমন একটি ওপেনসোর্স প্রজেক্ট, যার মাধ্যমে আপনি নিজের ঘরটাকেই আস্ত একটা সিনেমা হলে বানিয়ে ফেলতে পারবেন! শুধু তাই নয়, দেখতে পারবেন নতুন নতুন টিভি সিরিজও! তবে আপাততঃ মুভি দেখতে নয়, পপকর্ণ নিয়ে বসে পড়ুন এই পোষ্টটি পড়তে।
পপকর্ণ টাইমঃ ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে টরেন্ট দিয়ে মুভি নামানোর দিন শেষ! বাচঁবে আপনার সময়, সেই সাথে হার্ড ডিস্কের জায়গাও!
মুভি এবং এবং টিভি সিরিজ যারা নিয়মিত দেখেন, তারা বিট টরেন্ট কি জিনিস বেশ ভালো করেই জানেন। এমনকি যারা এটা ব্যবহার করেন না, তারাও জানেন। আধুনিক পৃথিবীতে বিদেশী মুভি প্রতিটি দেশের সাধারন জনগনের দোরগোড়ায় পৌছেঁ দিয়েছে বিট টরেন্ট। অনলাইনে বড় ধরনের ফাইল শেয়ারিংয়ের জন্য নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়াররা বানান পিয়ার টু পিয়ার ফাইল শেয়ারিং পদ্ধতি। বিট টরেন্ট হচ্ছে তেমনি একটি প্রোটোকল। বড় ধরনের ফাইল আদান প্রদানের জন্য পৃথিবীতে বিট টরেন্ট হচ্ছে অন্যতম সুলভ, কমন ও প্রধান জনপ্রিয় মাধ্যম। প্রসংগত একটা তথ্য দেই, পৃথিবীর মোট ইন্টারনেট ট্রাফিকের প্রায় ৮০ ভাগই পিটুপি নেটওয়ার্ক দ্বারা পরিচালিত হয়। এবং পৃথিবীর মোট ইন্টারনেট ব্যান্ডইউথের প্রায় ৯ ভাগ শুধু বিট টরেন্ট ক্লায়েন্টরাই ব্যবহার করে! (সূত্রঃ প্যালো আলতো গবেষনা সেন্টার)পপকর্ন টাইম নিয়ে বলার আগে, এর পেছনের আপাতঃ এ্যাডভেঞ্চারাস কাহিনীটা একটু সংক্ষেপে বলে নেই। আর্জেন্টিনার একদল মেধাবী তরুন সফটওয়্যার প্রোগ্রামাররা দুটো ব্যাপার বিশ্বাস করতেনঃ
১. পৃথিবীতে পাইরেসি হলো আদতে এক ধরনের “সেবাগত সমস্যা”। যে সমস্যাটি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরী করেছে পৃথিবীর কিছু প্রতিষ্ঠান। যে সব প্রতিষ্ঠান তরুনদের নিত্য নতুন যেসব উদ্ভাবন তাদের কোম্পানির মতাদর্শর বাইরে গেছে, জগতের কাছে সে সব উদ্ভাবনকে রীতিমতো হুমকিসরূপ তুলে ধরে। তা সেটা যত সৃজনশীল, ন্যায্য বা প্রয়োজনীয়ই হোক না কেন।
২. মুভি ষ্ট্রিমিং প্রোভাইডারেরা আসলে এক একটা বানচুদ। তারা তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অংকের মাসিক বা বাৎসরিক ফি নেয় অথচ মুভি দেখার ব্যাপারে বেহুদা বিভিন্নরকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তারা তাদের ইচ্ছেমতো কোন মুভি কোন এলাকায় রিলিজ করে। যেমনঃ There’s Something About Mary – এ মুভিটি প্রায় ১৮ বছর আগের। অথচ আর্জেন্টিনার মুভি ষ্ট্রিমিং ব্যাবসায়ীরা এটাকে নতুন রিলিজ হিসাবে দেখিয়েছে! (সুতরাং, আর্জেন্টিনার প্রোগ্রামারদের মেজাজ খারাপ হবার কারনটা সহজেই অনুমেয়!)
বলা বাহুল্য, উপরের দুটি বিশ্বাস আমি আমার নিজের ভেতরও লালন করি। মূলতঃ এই দুটি বিশ্বাস থেকেই তারা অনেকদিন ধরেই অনুভব করছিলো এমন একটি শক্তিশালী টরেন্ট ক্লায়েন্ট এর প্রয়োজনীয়তা, পাইরেসির সেবাগত সমস্যা দূর তো করবেই, এমনকি স্ট্রিমিং বানচোদদের একটা জন্মের মতো শিক্ষা দেবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। গত বছর, মাত্র দুই সপ্তাহের ভেতর আর্জেন্টিনার সেই মেধাবী তরুনের দল অত্যন্ত সফলভাবে ’পপকর্ণ টাইম’ এর সোর্সকোড লিখে ফেলে। বিট টরেন্টের ইতিহাসে লেখা হয় এক অভিনব অধ্যায়! এটি আদ্যোপান্ত লেখা হয়েছে node.js এ। যারা জাভাস্ক্রিপটিং জানেন, তারা জানেন নোড জেএস কিরাম মাল!!
এরপর তারা সফটওয়্যারটিকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখেনি। বরং ওপেনসোর্স প্রকল্প হিসেবে ছড়িয়ে দিলো, পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিলো এর সোর্সকোড। এর ফলে, সারাবিশ্বের যে কোন প্রোগ্রামার এখন এটির সোর্স কোডে নিত্য নতুন কোড যুক্ত করে একে ক্রমেই উন্নত থেকে উন্নততর করে যাচ্ছেন। (ইতোমধ্যেই একে ৪৫টি ভাষায় স্থানীয়করণ করা হয়ে গেছে!) এই কারনেই এটি হয়েছে একইসাথে অনেক বেশী স্মার্ট, জনপ্রিয়, সহজ আর টেকসই। টেকসই মানে পৃথিবীর কোন এন্টি পাইরেসি গ্রুপ এটায় হানা দিয়ে সরিয়ে ফেলতে পারবে না। আমার এই লেখাটি পড়ার পর কোন বাংঙ্গালী গ্রোগ্রামার যদি এই প্রজেক্টে নিজেকে যুক্ত করতে চান, তবে তিনি গিটহাবে এটি খুজেঁ পাবেন।
জনশ্রুতি রয়েছে যে, মুভি পাইরেসি জগতের কুখ্যাত একাধিক ওয়ারেজ ’পপকর্ণ টাইম’ এর সাথে সরাসরি জড়িত। আর যেহেতু এটি একটি অলাভজনক সেবাখাত, সেহেতু এর ব্রান্ডিং, লোগো ডিজাইন, প্রোমোশন সবই করা হয়েছে ভলান্টিয়ারিলি। প্রোগ্রামিংয়ের ইতিহাসে ’পপকর্ণ টাইম’ কে দেখা হয় ওপেনসোর্স প্রজেক্টের অন্যতম সেরা এক উদাহরন হিসেবে।
গত বছরের মাঝামাঝি যখন ’পপকর্ণ টাইম’ এর ঘোষনা দেয়া হলো, তখন ইউরোপ আমেরিকার মুভি পাড়া ও টেক দুনিয়া -উভয় জাগাতেই মুটামুটি হৈ চৈ পড়ে গেলো। পৃথিবীর বিখ্যাত সব নিউজ জার্নাল (যেমনঃ পিসিম্যাগ, বিবিসি টেক, সিনেট, ওয়াশিংটন পোষ্ট প্রভৃতি) একে ফিচার করে প্রবদ্ধ ছাপালো। সবারই এক কথা, ’পপকর্ণ টাইম’ এর জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারন হবে এর রিচ লাইব্ররী আর সহজ অথচ চিত্তাকর্ষক ইউজার ইন্টারফেইস। কেউ কেউ তো এও বল্ল, আগামী কয়েক মাসের ভেতরই ’পপকর্ণ টাইম’ নেটফ্লিক্স এর চরম প্রতিদ্বন্ধী হয়ে দাড়াঁবে। এবং তাদের অনুমান মিথ্যা হয়নি।
’পপকর্ণ টাইম’ এর রয়েছে অপারেটিং সিস্টেমভেদে ৫ টি ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফরম। উইন্ডোজ, ম্যাক, লিনাক্স, এমনকি আইওএস ও এন্ড্রয়েড এ্যাপও! পৃথিবীতে এত আধুনিক আর সহজ বিট টরেন্ট ক্লায়েন্ট এখন পযন্ত আর আসেনি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যাপারটি নিয়ে খুবই উত্তেজিত। ষ্ট্রিমিং মুভি এবং টিভি সিরিজ দেখার জগতে যে আমূল পরিবর্তন পপকর্ন টাইম এনেছে, সেটা সবাইকে জানানোর জোর তাগিদ অনুভব করেছি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে, নিজেই একটাবার ট্রাই করে দেখুন। ফাইল সাইজ মাত্র ২৮ এমবি। (উইন্ডোজ চালিত পিসি/ল্যাপটপের জন্য।) আর লাগবে অল্প কিছু ব্যান্ডইউথ। আমি মাত্র ৫০০ কেবিতেও চমৎকার মসৃন গতিতে চালাতে পেরেছি।
প্রশ্ন আসতে পারে, মুভি নামানো আর উপস্থাপন করা, এসব অনেকটাই অনলাইনের গতানুগতিক বিট টরেন্ট ক্লায়েন্ট এর মতো যদি হয় তবে এর থেকে তাদের পার্থক্য কোথায়? বা কেন আপনি পুরনো ক্লায়েন্টগুলো বাদ দিয়ে পপকর্ণ ব্যবহার করবেন? এই দেখুন উত্তরঃ
’পপকর্ণ টাইম’ এ রয়েছে ৭২০ অথবা ১০৮০ ব্লু রে প্রিন্ট দেখার সুবিধা। সুতরাং নিজের ব্যান্ডইউথ বা মনিটরের সাইজ অনুসারে পছন্দ করে নিতে পারেন কোন প্রিন্ট দেখবেন। আছে ম্যানুয়ালি সিড যুক্ত করার ব্যবস্থা। এছাড়াও, এর রয়েছে দৃষ্টিনন্দন একটি বিল্ট ইন প্লেয়ার আর খুবই সুলভ একটি সাবটাইটেল ইন্টারফেস। এমনকি আপনি চাইলে ওএসের ক্যাশ থেকেও IDM দিয়ে ডাউনলোড করতে পারবেন পুরো মুভিটি। এখানে রয়েছে ষ্টেপ বাই ষ্টেপ ইউটিউব ভিডিও।
আরেকটা বড় ব্যাপার হলো, প্রচলিত টরেন্ট ক্লায়েন্ট মুভি নামানো শেষ হলেও সেটা অটোমেটিকলি সিড করতে থাকে, যতক্ষন না আপনি ম্যানুয়ালি সেটাকে অফ করছেন। কিন্তু, আপনি ’পপকর্ণ টাইম’ এর উইন্ডো বন্ধ করার সাথে সাথে এটি সিড করাও বন্ধ করে দেবে, ফলে বাচঁবে আপনার ব্যন্ডইউথ।
বলা বাহুল্য, ’পপকর্ণ টাইম’ কে অনলাইনের বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বিভিন্ন দেশের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে উঠে পড়ে লেগেছে। সুতরাং, তার আগেই চলুন, ’পপকর্ণ টাইম’ এর অভূতপূব অভিজ্ঞতটুটুক নিয়ে ফেলি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ওয়ারেজদের উপর বিপুল পরিমান আস্থা রাখি। এরা ’পপকর্ণ টাইম’ কে এত সহজে হারিয়ে যেতে দেবে না, এ ব্যাপারে আমি একেবারেই নিশ্চিন্ত।
প্রসংগত উল্লেখ্য, ’পপকর্ণ টাইম’ কে ইতিমধ্যেই UK এবং ইজরায়েলে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে কপিরাইট আইনের অধীনে। এমনকি জার্মানীতেও এটিকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চলমান। এই কারনে ’পপকর্ণ টাইম’ নামানোর সময় “Downloading copyrighted material may be illegal in your country. Use at your own risk.” এ কথাটি বড় করে উপরে লেখা থাকে। আমাদের দেশে যেহেতু এটা অবৈধ নয়, বা হলেও এই আইনের প্রয়োগ নেই বল্লেই চলে, সেহেতু আমাদের দেশ থেকে এটি ব্যবহারে কোন অসুবিধা হয় না।
আমি ’পপকর্ণ টাইম’ এ এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে, টরেন্ট দিয়ে মুভি নামানোর কথা এখন আমার মনেই হয় না। ’পপকর্ণ টাইম’ চালু করি, সার্চ বারে মুভির নাম লিখে খুজিঁ, রেজাল্ট আসলে ক্লিক করি। ঠিক ১ মিনিট পর মুভি চালু হয়। এরপর পুরোটা সময়ই মনে হয় আমি যেন আমার পিসি থেকে ডাউনলোড করা মুভিই দেখছি।
সব মুদ্রারই এপিঠ ওপিঠ দুপিঠই থাকে। পপকর্ণ টাইমের দেখাদেখি আরেক দল বিপথগামী প্রোগ্রামারের দল একই সোর্সকোড ব্যবহার করে বানালো এমন এক বিট টরেন্ট, যেটা শুধুমাত্র নীল ছবি দেখার কাজেই ব্যবহৃত হয়। অশ্লীলতার প্রচারণা হবে বিধায় এটা নিয়ে আর কোন বাক্যব্যয় করবো না এখানে।
পপকর্ণ টাইমের ফেসবুক পেজ।
যারা এটি ব্যবহার করে, তাদেরকে বলা হয় Popcorners. চলুন এখনি নামিয়ে দেখি আর হয়ে যাই Popcorners!
Popcorn Time এখনো বেটাই রয়ে গেছে। বেটাতেই এই অবস্থা, ফাইনাল রিলিজে কি দিবে আল্লাহই জানে!!!